সান্যাল বাড়ির বসার ঘরময় ছুটে বেড়াচ্ছে একটা চার বছরের বাচ্চা মেয়ে আর তার পেছনে তার মা ছুটতে ছুটতে হাঁপিয়ে গিয়ে সোফায় বসে বলে উঠলো,
-সোনা মা এবার দাঁড়িয়ে যা কিন্তু বলছি, যদি উঠতে হয় আমাকে পিঠের ছাল চামড়া লাল করে ছাড়বো বলে দিলাম।
শতদ্রু বাবু- কে পিঠ লাল করছে শুনি আমার ফ্রেন্ডের?
নিজের খেলার সাথীকে দেখতে পেয়ে সাথে সাথে বাচ্চা মেয়েটা তার কাছে দৌঁড়ে গিয়ে হাত দুটো উপরে তুলে দিল। মানে এখন তাকে কলে নিতে হবে। শতদ্রু বাবু বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে সোফার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
শতদ্রু বাবু -আমার ফ্রেন্ডকে কেন মারবি বলেছিস, আমার ফ্রেন্ড তো ব্রেভ গার্ল তাই না ফ্রেন্ড?
বাচ্চা মেয়েটি মাথা নাড়িয়ে জবাব দিল, -হ্যাঁ তো, কিন্তু মাম্মা আমাকে সারাক্ষণ দুধ খেতে বলে ,দুধটা কি পচা গন্ধ।
শতদ্রু বাবু- কিন্তু ,ফ্রেন্ড …আচ্ছা চলো তোমাকে আজকে হট চকলেট খাওয়াবো ,দে তুই আমাকে দুধটা দে তো, শেষের কথাটা বলে ভদ্র মহিলার কাছ থেকে দুধের গ্লাসটা নিয়ে নিলেন শতদ্রু বাবু।
শতদ্রু বাবুর স্ত্রী বিপাশা দেবী ওখানে এসে বললেন,
বিপাশা দেবী - কী রে স্রোত, লোকটা আবার বাচ্চাটার মাথা বিগরতে উঠে পড়ে লেগেছে তো? ঐ জন্য বলি এত লাই দিবি না, বাচ্চাটাকে সকাল সকাল চকলেট খাওয়াবে বলে উঠে পড়ে লেগেছে।
ভদ্র মহিলাটি হেসে উত্তর দিল,
-তুমি আর দাদা, যত খুশি ঝগড়া করো আমি কলেজের জন্য বেরোলাম।
বিপাশা দেবী - এত তাড়া কিসের খেয়েদেয়ে ধীরে সুস্থে বেরোস এখনো অনেকটা টাইম আছে।
- খাওয়া হয়ে গেছে আমার, আসলে আজকে আমাদের ডিপার্টমেন্টের political philosophy -র নতুন প্রফেসর আসবেন তাই একটু তাড়াতাড়ি যেতে হবে। রোহিণী ম্যাম বলেছেন।
বিপাশা দেবী- আচ্ছা বেশ খাওয়া তো হয়ে গেছে ওষুধ খেয়েছিস তো।
- এইরে একদম ভুলে গেছি।তারপর ওষুধ খেয়ে বেরিয়ে যায় মহিলাটি।
কি ভাবছো ভদ্র মহিলাটা কে ?এই ভদ্র মহিলাটিই হল এই গল্পের মুখ্য চরিত্র স্রোতস্বিনী বসাক, বয়স ৩১ বছর, দর্শনে PhD হোল্ডার ,ওনার স্পেশাল পেপার ছিল লজিক, বর্তমানে একটি কলেজে স্টুডেন্ট পড়ান, আর বাচ্চা মেয়েটি হল স্রোতস্বিনীর মেয়ে মোহনা বসাক।বর্তমানে সান্যাল বাড়িতে নিজের মেয়েকে নিয়ে থাকছে স্রোতস্বিনী , প্রায় গত সাড়ে চার বছর ধরে এটাই ওদের ঠিকানা। সান্যাল বাড়ির এই দম্পতি মানে শতদ্রু বাবু আর বিপাশা দেবী এক 50ঊর্ধ্ব দম্পতি স্রোতস্বিনীকে নিজেদের মেয়ের চোখে দেখেন বলতে গেলে।আরও একজন আছে যেই মানুষটা সান্যাল বাড়িতে বাজার করা, গাড়ি চালানো, বাগানের পরিচর্চা করা এই সমস্ত কাজ করেন নাম ভীম পাল।
শতদ্রু বাবু আর বিপাশা দেবীর এক ছেলে আছে তবে সে এখন প্রায় ১০ বছর হতে চলল বিদেশে পড়াশোনার জন্য গেছে, তার সাথে স্রোতস্বিনীর পরিচয় হয়েছে ফোন মারফত ,মোহনার সাথে তো সামনাসামনি না দেখা হলেও মামা-ভাগ্নির সম্পর্ক অনেকটা গভীর তাদের মধ্যে।
🍂🍂🍂
অন্যদিকে,মুখার্জি বাড়িতে, বাড়ির ছোট ছেলে সমুদ্র খাবার টেবিলে বসে বলে ওঠে,
সমুদ্র- মা খেতে দাও তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে আমাকে।
বাড়ির বড় ছেলে সাগর বলে ওঠে,
সাগর- হঠাৎ করে তোর মাথায় কলেজে জয়েন করার ভূতটা চাপলো কেন? আমাদের এত বড় ফোর হুইলার গাড়ির কোম্পানি আছে তার সত্বেও, তুই এসব নিয়ে পড়াশোনা করতে চাসনি তার জন্য আমরা তো কখনো চাপ দিইনি তার মানে এটা নয় যে তুই বাড়ির ব্যবসা না করে মাস মাইনের চাকরি করবি। আমরা সবাই চাইছিলাম অন্ততপক্ষে বিদেশ থেকে ফেরার পর তুই কোম্পানি জয়েন করবি।
সমুদ্র -আমি কিছুদিন যাবৎ…কিছুদিন কি বলছি কিছু বছর যাবৎ কয়েকটা প্রশ্ন নিয়ে ঘোরাফেরা করছি। সেই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাওয়ার পরেই আমি চাকরিটা ছেড়ে দেব, তোকে চিন্তা করতে হবে না। আর আমি প্রতিদিন তো কলেজ যাচ্ছি না সপ্তাহের তিন দিন আমার লেকচার আছে বাদ বাকি দিন আমি কোম্পানি যাব।
সাগর- আচ্ছা বেশ তুই যেমনটা চাস, কাম্মা আমাকেও খাওয়ারটা দিয়ে দাও।
গঙ্গা দেবী সমুদ্র আর সাগরকে খাবার দিয়ে সমুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বলল,
গঙ্গা দেবী -সমুদ্র এবার অন্তত একটা বিয়ে কর ৩১ তো পেরিয়ে গেল বল।
সমুদ্র নিজের মুখের কাছে নিয়ে যাওয়া খাবারটাকে আবারো প্লেটে নামিয়ে রেখে নিজের মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
সমুদ্র -তুমি কি এই সমস্ত কথা আমাকে বলবে বলে খাবারটা নিয়ে এলে।
গঙ্গা দেবী নিজের ছেলের এরকম উল্টো সুরে কথা বলা শুনেই বুঝতে পেরেছেন আর যদি একটু বেশী কিছু বলেন তাহলে এই ছেলে খাওয়া ছেড়েই উঠে যাবে তাই জন্য চুপ করে গেলেন।খাওয়া ছেড়ে বেরিয়ে যাবে এমন মুহূর্তে সাগরের সাড়ে চার বছরের ছেলে অরণ্য এসে হাজির হয়, সমুদ্রের কাছে আসতেই সমুদ্র ভাইপোকে কোলে তুলে নেয় সমুদ্রের গলা জড়িয়ে ধরে অরণ্য বলে,
অরণ্য- কাকাই আমার কাম্মা কখন আসবে বাবাইয়ের কাম্মা আছে ,পিপির কাম্মা আছে , মাম্মামকে জিজ্ঞাসা করতে মাম্মাম বলল তোমাকে জিজ্ঞাসা করতে।
অরন্যর কথা শুনে সমুদ্র বাড়ির সকলের দিকে একটা কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অরণ্যের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
সমুদ্র- কাম্মা একটু ব্যস্ত আছে তাই জন্য এখন আসতে পারছে না যখন ফ্রি হবে তখন নিয়ে আসবো কেমন?
অরণ্য - আচ্ছা।
সমুদ্র বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে কলেজের উদ্দেশ্যে ।
🍂🍂🍂
কলেজে পৌঁছতেই philosophy dipertment এর হেড রোহিণী মজুমদার (ন্যায় স্পেশালিস্ট) স্রোতস্বিনীকে বলে ওঠেন,
রোহিণী ম্যাম - এত দেরী হলো যে?
স্রোতস্বিনী- আসলে আমার মেয়েটা খেতে চাইছিল না তারওপর আবার কোলকাতার ট্রাফিক সব মিলিয়ে একটু দেরী হয়ে গেলো আর কি,
রোহিনী ম্যাম- ও আচ্ছা, ঠিক আছে।
কলেজের ফিলোসফি ডিপার্টমেন্টের নতুন টিচার উপস্থিত হতেই ডিপার্টমেন্টের সকল টিচারেরা নিজেদের আনা ফুলের তোড়া গুলো দিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানায়। অন্য সকলের থেকে ফুলের তোড়া নেওয়া হয়ে গেলে সেই মানুষটা যখন স্রোতস্বিনীর কাছে এসে দাঁড়ায় স্রোতস্বিনী তাকে ফুলের তোড়াটা না দিয়ে টেবিলে রেখে দেয় স্রোতস্বিনীর এমন আচরণ দেখে অন্যান্য শিক্ষিকা শিক্ষকরা ও অবাক হয়ে যান আর ব্যক্তিটি বাঁকা হেসে স্রোতস্বিনীকে জিজ্ঞাসা করে,
-ফুলটা দিলেন না যে।
স্রোতস্বিনী -এটা অর্কিড,
রোহিণী ম্যাম -হ্যাঁ অর্কিড তো কি হয়েছে?
-ও তাহলে ফুলের তোড়াটা না দিয়েই ভালো করেছেন, অর্কিডে আবার আমার আসলে এলার্জি আছে,
কথাটা বলে ব্যক্তিটি গিয়ে বসে পড়ে নিজের চেয়ারে , আর সকলেও যে যার ক্লাস করাতে চলে যায় ।
স্রোতস্বিনী খানিকক্ষণ ব্যক্তিটির দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের ক্লাস করাতে চলে যায়। ভাবছেন ব্যক্তিটি কে ?
-এটাই হলো সমুদ্র মুখার্জি , philosophy তে PhD হোল্ডার ,পলিটিক্যাল ফিলোসপিতে স্পেশালিস্ট লেকচারার, বয়স ৩১ বছর, বর্তমানে অবিবাহিত নন কিন্তু, এই কথাটা কেউ জানে না।
কিছুক্ষণ আগে,সমুদ্র টিচার্স রুমের মধ্যে প্রবেশ করার আগে কাঙ্ক্ষিত নারী অবয়ব কে দেখে ওর পা দুটো থমকে গিয়েছিল দাঁড়িয়ে পড়েছিল ।
কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে ছিল নারী অবয়বটির দিকে যাকে ও চিনত সেই মানুষটার থেকে সম্পূর্ণ যেন আলাদা আর একটা মানুষ । ও যাকে চিনত তার চুলটা পিক্সি কাট বা উলফ কাটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল ,সর্বদা সে জিন্স প্যান্ট আর নইলে ট্রাকসুট পড়ে থাকতো ,পায়ে স্নিকার্স , গায়ে একটা ঢলা গেঞ্জি কখনো টি শার্ট আর খুব মেয়েদের মত সাজ বলতে একবার দেখেছিল তাকে লং ড্রেস পড়ে ফেয়ার ওয়েলের দিন, তবে অর্ধেক অনুষ্ঠান শেষ হতে না হতেই তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি ।কিন্তু ,আজ দেখে মনে হচ্ছে ও যেমন মেয়ে পছন্দ করত কয়েক বছর আগে ঠিক তেমন মেয়েই যেন ওর সামনে এসে হাজির হয়েছে। কোমর অব্দি লম্বা বিনুনি ,শাড়ি পড়া, স্নিগ্ধ মুখের অধিকারীনি, মুখে মেকআপ চড়ানো নেই তারপরেও অপরূপা সুন্দরী। যেটাকে সমুদ্রের মায়ের ভাষায় বলে মা লক্ষ্মীর মত দেখতে।
ভাবনা শেষেই পা বাড়িয়েছিল টিচারস রুমের ভেতরে স্রোতস্বিনীকে অর্কিড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরো একটু মজাই পেয়েছিল কারণ ও জানতো যে যেই জিনিসে ওর এলার্জি আছে সেটা কখনোই স্রোতস্বিনী ওর হাতে তুলে দেবে না।
ক্রমশ…
গল্পটা পড়ে কেমন লাগলো জানাবেন সকলে 🤗